এক
সেবার নদীতে শুধু খরা এলোই, আর ফিরে গেলোনা। সে খরায় আধপাকা ধান পুড়ে খই হল খেতেই।
চৈত্রের কাঠফাটা রোদ্দুর গিয়ে যখন ভরা বাদল নামল, গাঁয়ের লোক ভাবল, যাক এবার বুঝি নদীর বুকে জল ফিরে আসে। কিন্তু জল যা জমল তাতে নৌকো ভাসানো দুরে থাক, ছেলেপিলেরা লাফ ঝাপ দিয়ে গোসল করতে গিয়েও খুব একটা সুবিধা করতে পারল না। শরীর পরিষ্কার হবার বদলে কাদায় ভুত হয়ে ফিরল এক একটা।
উপায় না দেখে দিশেহারা গাঁয়ের লোক এক সন্ধ্যায় জড়ো হল জমির উদ্দিনের উঠোনে। আকাশে চাঁদ ছিলোনা। হারিকেন জ্বালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু খরার ভয়ে কালো হয়ে যাওয়া গাঁয়ের লোকের মুখের কাছে সেটা খুব একটা জুত করে উঠতে পারলনা।
ফিস ফিস করে চলল আলোচনা। এমনভাবে যেন তাদের আশপাশ ঘিরেই আছে খরার সৃষ্টির কোন অপশক্তি লুকিয়ে। নানা গুজবে ভারি হয়ে উঠল বাতাস। কেউ বলল, হয়তো হঠাৎ করে নদীর কোথাও কোন চুনাপাথরে টিলা ভেসে উঠেছে। আর সেটাই সব জল শুষে খাচ্ছে। কেউ বলল, যে কাঁদুনে বুড়ির চোখের জলে সৃষ্টি হয়েছিল এই নদী বুড়িই বুঝি মারা পড়েছে কোন কঠিন রোগে। কেউ আরও এক কাঠি সরস, তাদের মতে বিশাল এক হাতি এসে সাবাড় করে দিয়েছে নদীর সব জল।
সেসব কথায় ভয়ে কৌতূহলে যখন প্রায় গোল আলুর মত হয়ে উঠেছে এক একটা লোকের চোখ তখুনি ধমকে উঠলেন জমির উদ্দিন, কি পোলাপানের গপ পাড়তাছো একেকজন। এইসব গলা হুগাইন্না কতা বাদ দিয়া কেমনে গলা ভিজানো যায় হেই বুদ্ধি কর।
গাঁয়ের লোক সমস্বরে তাকে সমর্থন জানালো, হ হ , তাই হোক , তাই হোক। কিন্তু একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আলোচনার পর যারা ঘুমোতে গেল সকালে ঘুম থেকে উঠার পরও তাদের মুখ থেকে থেকে সে রাতের অন্ধকার দুর হলোনা। গাঁয়ের লোকের কপালের ভাজে ভাজে অন্ধকারেরা পুরো পরিবার নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে বাসা বেঁধে বসল।
জমির উদ্দিন গ্রামের সমৃদ্ধশালীদের মধ্যে একজন। গেলো মাসে খরায় ধান নষ্ট হওয়ায় অন্যরা লোকেদের পরিবারে যখন খাবারের টানা টানি পড়ছে তিন-বেলা সেখানে তার পরিবার এসবের আঁচ কিছুই পায়নি। কিন্তু দুশ্চিন্তা বাসা বেধেতে তার মাথায়ও। একবার ফসল নষ্ট হওয়ায় তার কিছু হয়নি ঠিক, কিন্তু আসছে সিজনে ধান না লাগাতে পারলে আর সবার মত তারও না খেয়ে মরতে হবে নির্ঘাত!
নদী শুকিয়ে হয়ে আছে খটখটা। হাটে ধান আনা নেওয়ার জন্য গেলোবার নতুন একটা নৌকা কিনেছিল সে। সেটা চড়ায় আটকে এখন প্রায় জীর্ণতার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। রোদ এসে ওটাকে একবার ভেজায়, আবার বাদলার পানি এসে ভিজায় কিন্তু পানি যা জমে তাতে আর ভাসা হয়না ওটার।
অন্দর মহলে খুব একটা চেঁচামেচি চলছে অনেক খন ধরে। জমিরের ছোট ছেলেটা নদীর কাদা পানিতে ধাপিয়ে এসে এখন মায়ের হাতে মার খেয়ে চেঁচিয়ে কাঁদছে। বোন গিয়েছিলো ভাইকে বাঁচাতে, তাকেও দু ঘা লাগিয়েছে মা। নিরপরাধে মার খেয়ে সে নালিশ জানাতে এসেছিল বাবার কাছে। কিন্তু মুখ অন্ধকার করে বসে থাকা বাবার চেহারা দেখে আর সাহস পেলোনা কিছু বলতে।
জমির উদ্দিন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেও পুরো জিনিসটাই সে খেয়াল করলে সে। কোন ভ্রুক্ষেপ হলোনা তার। বারান্দায় দাদার আমলের লোহা কাঠের চেয়ারটায় হেলান দিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে রইল। এসব ছোটখাটো ব্যাপার তার কাছে এখন তুচ্ছ। সে ভাবছে আরও বড় দুর্যোগের কথা, না খেয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে মরার চিন্তা এখন তার মাথায়!
দুই
গ্রামে রৈ রৈ পড়ে গেল জমির উদ্দিনের নামে। রীতিমত তার নামে আনন্দ মিছিল নিয়ে পুরো গ্রামে যেন পাক দিতে লাগল গ্রামের লোক। নদীর জলের যখন কোন দেখা নাই, ফসল কিভাবে রুপবে সে নিয়ে গ্রামের লোকের দুশ্চিন্তা যখন চরমে তখন জমির উদ্দিন নিজের টাকায় শহর থেকে কারিগর এনে সেচ মেশিন বসালেন মাঠে। সে সেচ মেশিন দিয়ে ইঞ্জিনের গড় গড় আওয়াজের সাথে কুল কুল করে উঠল পানি। সে পানি ড্রেনে করে পোঁছে গেল যার যার জমিতে। এতে করে তাদের পকেটের কিছু টাকা পয়সা খসলেও সে সেচের পানিতে যখন সদ্য রুপা ধান গাছগুলো সজীব হয়ে উঠল তখন আনন্দে নেচে উঠল তাদের মনও।
আজকাল আর গ্রামের ছেলেরা নদীর কাদা পানিতে আর ধাপাধাপি করেনা। সেচ মেশিনের ড্রেনের ঝকঝকে আর ঠাণ্ডা পানিতেই এখন তাদের জলকেলি চলে। গায়ে কাদাও জমেনা, মায়ের হাতের মারও খেতে হয়না।
গ্রামের পরম্পরা নব বধূকে নিয়ে বর জ্যোৎস্না রাত্রিরে এখন আর নদীর বুকে নৌকা নিয়ে ভেসে পড়েনা। নব বধূদের আবদার রাখতে নিঝুম রাতে এখন তাদের নিয়ে যাওয়া হয় সে আজব কল দেখাতে। নিশ্চুপ সে রাতে নিস্তব্ধ ইঞ্জিনের সাথে থেমে থাকা অসহায়ের মত সেচ কলটাকে দেখে সহসা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনা যে, এটাই সারা গ্রামে শব্দের গর্জন তুলে দিনের বেলায় মাটির নিচু স্তরে মায়ের কোলে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকে জলকে টেনে এনে উগরে ফেলে ফসলের মাঠে।
যাহোক, খেতের ফসলের সাথে গ্রামের মানুষের যে একটা আত্মিক টান আছে তা টের পাওয়া যায় ধান গাছগুলোতে যখন বাড়ন্তের ছোঁয়া লাগে। সদ্য যৌবন প্রাপ্ত ধানগাছ গুলো যখন দখিনা হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দোল খায় তখন কৃষকদের মনে লাগে রঙ।
সারাদিন পর সন্ধ্যা যখন ভর করে আসে, তখন হারিকেনের আলোয় বাউলা গানের আসর বসে জমির উদ্দিনের বাড়িতে। আকাশে খিল খিল করে উঠে চাঁদ। গাঁয়ের লোকের আনন্দ দীপ্ত মুখগুলো সে পরিবেশটাকে করে তুলে আরও আনন্দ মুখর।
মাঝ রাত্রির পর চাঁদ ডুবলে কেউ ঘুমোতে যায়, কেউ নব বধূর পাশে শোয়ে আগামী দিনের স্বপ্ন রুপে।
তিন
ফসল পাকতে শুরু করেছে কেবল । তখুনি হঠাৎ করে ঘটে ঘটনাটা। যে মৃত নদীর শুষ্ক বালিতে নিশ্চিন্তে বাসা বেঁধেছিল পিঁপড়ার দল, সে মৃত নদী আবার হঠাৎ করে জেগে উঠে। কল কল করে প্লাবন নদীর বুকে। দীর্ঘ বিরহের পর গভীর প্রেমে মত্ত প্রেমিকার মত জল উছলে পরে নদীরে দুধার বেয়ে। তাদের সে মিলন উৎসবের গর্জনে ঢাকা পড়ে পুরু গাঁয়ের মানুষের কান্নার ধ্বনি। সো সো শব্দে প্রবল উচ্ছ্বাসে জল ঝাঁপিয়ে পড়ে পুরো গাঁয়ের বুকে। ভেসে যায় কতো গেরস্থের গরু, গৃহিণীর হাস মুরগি আর তার সাথে যায় প্রভু ভক্ত নেড়ি কুকুর।
প্রলয় যখন থামে, তখন পুরো গ্রামও থমথমে। ফসল তো ফসল, নদীর পাড় ঘেঁসে যাদের বাড়ি ছিল তাদের ভিটেমাটিরও কোন সন্ধান পাওয়া যায়না আর।
জমির উদ্দিনের ঘরটার তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি হয়নি তার পরিবারের কারোর ই। তার বাড়ির উঠোনে আশ্রয়হারা মানুষের ভিড় জমে উঠেছে। তাদের চিৎকার চেঁচামেচি আর হৈ হল্লা ছাপিয়ে জমির উদ্দিনের দৃষ্টি এখন মাঠের দিকে।
ফসলের মাঠটা জুড়ে এখন গভীর শূন্যতা। আর সে শূন্যতার মাঝে কেবল আশ্চর্যের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটা কল। একটা ইঞ্জিনের সেচ কল!
২০ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪